হুমায়ুন সিকদার
বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট:
গত কয়েক দশকে কুতুবদিয়া দ্বীপের জমির উল্লেখযোগ্য অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে মোট ভূমিক্ষয়ের হার শতকরা দশ ভাগ। উপকূলের ক্ষয় ও সঞ্চয়ের হার খুবই বেশি। বছরে শত মিটার স্কেলে তটরেখা সরে যাচ্ছে। বারবার জোয়ার-ভাটা, পূর্ণিমার জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে প্লাবন হচ্ছে। ২০১৯ সাল ও তৎপরবর্তী বছরগুলিতে একাধিক স্থানে ভাঙন ও প্লাবনের তথ্য নথিভুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা ও ঝড়ের তীব্রতা বাড়ার ফলে অবকাঠামো ঝুঁকি আরও বাড়ছে। সুরক্ষার ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতি বাড়তে পারে বহুগুণ।
বর্তমান অবস্থা:
কুতুবদিয়ায় প্রায় ৪০ কিমি বেড়িবাঁধ আছে।
তার মধ্যে ৬.৫ কিমি ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৮০০ মিটার সাম্প্রতিক সময়ে ভেঙে গেছে। ফলাফল: ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, লবণক্ষেত প্লাবিত। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে বারবার ভাঙনের ফলে বহু পরিবার উদ্বাস্তু হয়েছে এবং কুতুবদিয়া থেকেই ৫০-৬০ হাজার মানুষ দ্বীপ ছেড়েছে বলে স্থানীয় ও জাতীয় প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত কয়েক বছরে নির্মাণ/মেরামতে বড় অঙ্কের ব্যয় হলেও, প্রচলিত নকশা-মান ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতিতে নতুন বাঁধও দ্রুত ক্ষয়ে গেছে। দ্বীপবাসীর অভিযোগ- বিগত ৩৪ বছর অপেক্ষার পরও টেকসই সমাধান আসেনি। তবে BWDB ইতিমধ্যে ৬.৫ কিমি ‘সুপার ডাইক’ প্রস্তাব করেছে আলি আকবর ডেইল ও বাতিঘর এলাকার বাঁধের জন্য।
টেকসই বেড়িবাঁধ কেন প্রয়োজন:
প্রাণ ও সম্পদের সুরক্ষাসহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি, ঘরবাড়ি-বিদ্যালয়-হাসপাতাল, সড়ক বিচ্ছিন্নতা সবই কমবে।
জীবিকা রক্ষা:
লবণ, কৃষি, মৎস্য, ক্ষুদ্র ব্যবসা লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় মৌসুমি উৎপাদন ধ্বংস হয় যা বাঁধ স্থিতিশীল হলে ক্ষতি কমবে।
স্থানচ্যুতি ঠেকানো:
ধারাবাহিক ভূমিক্ষয় ও প্লাবনে জোরপূর্বক অভিবাসন বেড়েছে। টেকসই সুরক্ষা না হলে উচ্ছেদ আরও বাড়বে।
পরিবেশ রক্ষা:
ম্যানগ্রোভ/সবুজ বেল্ট থাকলে ঢেউয়ের শক্তি ভাঙে। টেকসই বাঁধের সঙ্গে সবুজ গাছের বেষ্টনী যুক্ত করলে বাঁধ হবে শক্তিশালী।
মৌলিক নাগরিক অধিকার বঞ্চনার চিত্র:
ঘনঘন প্লাবনে বাসস্থান হারানো, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ও সুরক্ষা না থাকলে নিরাপদ বসতির অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা:
ক্লিনিক/বিদ্যালয়ে জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষতি হয় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর। ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে সেবায় বিঘ্ন ঘটে। সাইক্লোন শেল্টার ও অ্যাক্সেস রোড ডুবে গিয়ে জনস্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
পানি ও জীবিকার অধিকার:
লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে পানীয়জল ও কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিরাপদ পানি ও জীবিকার অধিকারে বিঘ্ন ঘটে।
কী ধরণের টেকসই বেড়িবাঁধ প্রয়োজন:
সুপার ডাইক/উন্নত মানের বাঁধ। যথোপযুক্ত উচ্চতা, প্রশস্ততা, সোপান, আরমারিং (কংক্রিট ব্লক/জিওটেক্সটাইল টিউব/রক টোয়িং) ও সঠিক আউটফল কাঠামো; ন্যূনতম ৫০–১০০ বছর নকশা আয়ু।
➤পরিপূরক করণীয়:
১। জরুরি সুরক্ষা: বহুমুখী সাইক্লোন–শেল্টার, অবারিত অ্যাক্সেস রোড, নির্ভরযোগ্য ফেরি/নৌ–সংযোগ।
বর্ষার পানি সংরক্ষণ, কমিউনিটি RO/ডেসালিনেশন ইউনিট, স্থায়ী ড্রেনেজ।
জীবিকা–পুনরুদ্ধার: বিকল্প আয়ের প্রশিক্ষণ/ঋণ; ক্ষতিগ্রস্তদের টার্গেটেড সামাজিক সুরক্ষা।
২। সবুজ বেল্ট পুনর্গঠন:
কুতুবদিয়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ম্যানগ্রোভ বেল্টকে বৈজ্ঞানিকভাবে পুনঃস্থাপন। কুতুবদিয়া সামনের সারির জলবায়ু যোদ্ধা। প্রয়োজন টেকসই ও প্রকৃতি সমর্থিত সুপার ডাইক সবুজ বেল্ট। সঙ্গে সুসংহত রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন। এতে প্রাণ-সম্পদ রক্ষা হবে, উচ্ছেদ কমবে, আর বহুদিনের মৌলিক নাগরিক অধিকার বঞ্চনার বোঝা লাঘব হবে।

